ভাটপাড়ার প্রাচীন ব্রাহ্মণ ভূস্বামী হালদারগণের বংশপরিচয়।

ভাটপাড়ার বাশিষ্ঠ গুরুবংশের ইতিবৃত্ত সম্পূর্ণরূপে কহিতে হইলে তথাকার আদিম ভূস্বামী হালদার বংশের কিছু পরিচয় দেওয়া একান্ত আবশ্যক। এই উভয়বংশের এমনিই ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে একটির পরিচয়ের সঙ্গে অপরটির পরিচয় না দিলে ইতিহাস অসম্পূর্ণ রহিয়া যায়। সন ১৩৩১ সালে নারায়ণ স্মৃতিসমিতির উদ্যোগে আহূত ভাটপাড়া বশিষ্ঠবংশের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্রী ৺নারায়ণ ঠাকুরের আবির্ভাব মহোৎসব সভায় বাশিষ্ঠ অধ্যাপক শ্রীমান্‌ ভববিভূতি বিদ্যাভূষণ এম.এ. যথার্থই বলিয়াছিলেন যে: “বহুপূর্ব্বে একবার বঙ্গদেশে আদিশূর যেমন কান্যকুব্জ হইতে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আনয়ন করিয়া এ দেশে ক্ষুণ্ণ বৈদিকাচার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন তেমনি প্রায় ত্রিশতাধিক বৎসর পূর্ব্বে ভাটপাড়ার আদি ব্রাহ্মণ ভূস্বামী দুর্লভানন্দ হালদার মহাশয়ের পুত্র পরমানন্দ হালদার মহাশয়ও স্বীয় জমীদারীভুক্ত ভাগীরথীতীরবর্তী ভাটপাড়া গ্রামে বশিষ্ঠবংশীয় সিদ্ধ মহাপুরুষ শ্রী শ্রী ৺নারায়ণ ঠাকুর মহোদয়কে প্রতিষ্ঠিত করতঃ তদ্দ্বারা বর্ণাশ্রম ধর্ম্মের বহুল প্রচারকল্পে সাহায্য করিয়া আদিশূরের মতই পুণ্য কীর্ত্তি অর্জন করিয়া গিয়াছেন। বাস্তবিকই যিনি ধর্ম্মের গ্লানি উপস্থিত হইলে স্বয়ং অবতীর্ণ হইয়া ধর্ম্মের পুনঃ সংস্থাপন করিয়া থাকেন, সেই পরমপুরুষের নিদের্শানুসারেই কালবশতঃ ক্ষুণ্ণ বর্ণাশ্রমধর্ম্মের পুনরুদ্ধার সাধনার্থ বঙ্গের অন্যতম গুরুবংশ এই বশিষ্ঠবংশকে পুণ্য ভাগীরথীতীরে স্থাপিত করিয়া ভাটপাড়ার পুণ্যশ্লোক ভূস্বামী পরমানন্দ হালদার প্রাতঃস্মরণীয় হইয়া গিয়াছেন”। ইহা ব্যতীত ইনি এই সময়ে স্বশ্রেণীয় স্বজন ও কান্বায়ন-গোত্রীয় শুদ্ধাচার দাক্ষিণাত্য বৈদিক সম্প্রদায়ভুক্ত পুরোহিত প্রভৃতিকে ভাটপাড়ায় প্রতিষ্ঠীত করাইয়া সমাজের পুষ্টিসাধন করিয়াছিলেন। এক্ষণে এই বংশের কিঞ্চিৎ প্রাচীন ইতিবৃত্ত দিতেছি। আদিশূর কান্যকুব্জ হইতে পঞ্চ অগ্নিশিখাতুল্য যে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বঙ্গদেশে আনয়ন করিয়া তাঁহাদের পুণ্যপদরেণুস্পর্শে এ দেশকে ধন্য ও পবিত্র করেন ছান্দড় তাঁহাদের মধ্যে অন্যতম। ভাটপাড়ার এই হালদার ভূস্বামিগণ ঐ ছান্দড়েরই ধারা। ইঁহারা সামবেদী কুথুমীশাখী বাৎসগোত্রীয়। ঔর্ব্ব, চ্যবন, ভার্গব, জামদগ্ন্য, আপ্নূবৎ এই পঞ্চ ইঁহাদিগের প্রবর। এই বংশে বহু প্রখ্যাত পণ্ডিত ও তপোনিষ্ঠ সাধক মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়া ইহা অলকৃত করিয়া গিয়াছেন। আর্য্যাসপ্তসতী রচয়িতা গোবর্দ্ধনাচার্য্য এই ছান্দড়ের ধারায় জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি বঙ্গের শেষ হিন্দু নৃপতি লক্ষ্মণসেনের প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। ইনি ছান্দড় হইতে অধস্তন নবম পুরুষ। ছান্দড় হইতে ত্রয়োদশ পুরুষ চক্রপানি তপোনিষ্ঠার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁহা হইতেই তাঁহার পরবর্ত্তিবংশধরগণ এক্ষণ পর্য্যন্ত চক্রপাণি ঠাকুরের সন্তান বলিয়া পরিচিত। ১৬শ পুরুষ ভগীরথের সময় মেল বন্ধন হয়, তদনুসারে ইঁহারা শ্রীরঙ্গভট্ট বা সুরাই মেল আখ্যায় পরিচিত হন। বল্লালসেনের কৌলিন্যপ্রথানুসারে ইঁহারা কুলীন পদবী প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু ছান্দড়ের ১৭শ পুরুষ ভগীরথের পুত্র কৃষ্ণাই হইতে কুলভঙ্গ হয়। ইঁহাদের আদিম বাসস্থান যশোহর জিলার (বর্ত্তমান খুলনার) অন্তঃপাতী ভুগিলহাট গ্রাম। ছান্দড় হইতে ১৮শ পুরুষ বাদীন্দ্র চক্রচূড়ামণি প্রসিদ্ধ তপঃপরায়ণ ছিলেন। তিনি ভুগিলহাট গ্রামের নিম্নবাহিনী ভৈরবনদীর আক্রমণ হইতে গ্রামখানি রক্ষা করিবার জন্য তপোবলে ঐ নদীর বেগ ফিরাইয়া দিয়াছিলেন, এইজন্য তাঁহার অধস্তন বংশীয়গণ তথায় গাঙ্গফেরা ভট্টাচার্য এই খ্যাতি প্রাপ্ত হইয়াছেন। উক্ত বাদীন্দ্র চক্রচূড়ামণি মহাশয়ের পৌত্র ৺দুর্লভানন্দ সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে মুরসিদাবাদ নবাব সরকার হইতে হালদার এই উপাধিসহ ভাটপাড়া ও সন্নিহিত কতকস্থান জায়গীররূপে প্রাপ্ত হয়েন। তদবধি তদ্বংশীয়েরা ‘হালদার’ এই উপনাম ব্যবহার এবং ঐ জায়গীর জমীদারীরূপে ভোগ করিয়া আসিতেছেন। এই শুদ্ধশীল পরমানন্দই বশিষ্ঠবংশীয় শ্রী শ্রী ৺নারায়ণ ঠাকুরের তপঃপ্রভাব অবলোকন করিয়া তাঁহাকে গুরুরূপে বরণ করেন, ভাটপাড়ায় গঙ্গাতীরে ঠাকুরের সাধনাশ্রম করিয়া দেন ও ক্রমে এই গুরুশিষ্য সম্বন্ধ সন্নিহিত ও অবিচ্ছিন্ন রাখিবার জন্য ঠাকুরের পুত্র, পৌত্র, দৌহিত্র প্রভৃতিকে স্বনিকটে ভাটপাড়ায় ভূমি নিষ্কর ব্রহ্মত্রা করিয়া দিয়া বাস করান। তদবধি ভাটপাড়ার বশিষ্ঠবংশ ও হালদারবংশ পরস্পর স্নেহ ও শ্রদ্ধাসুত্রে সুখের বাঁধনে আবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। বড়ই আনন্দের বিষয় যে হালদার-বংশের উপস্থিত বংশধর মধুরোদারচরিত শ্রীমান্‌ অংশুপ্রকাশ ও অব্জপ্রকাশ প্রভৃতি ভ্রাভৃগণ উভয় বংশের সেই প্রাচীন সুখবন্ধন অশিথিল ভাবেই রক্ষা করিতেছেন। ঈশ্বর করুন আমরা যেন উভয়ে এই ভাবেই সদানন্দে কাটাইয়া যাইতে পারি। কালচক্র আবর্ত্তিত হইয়াছে, উভয়ের মনের ভাব যেন আবর্ত্তিত না হয় ইহাই ভগবৎসমীপে প্রার্থনা। পরমানন্দের অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ আনন্দরামহালদার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সমসাময়িক। এইরূপ কথিত আছে যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ভাটপাড়ার ঋষিকল্প পণ্ডিত মহোদয়গণের নিকট শাস্ত্র্রালাপশ্রবণার্থে মধ্যে মধ্যে ভাটপাড়ায় আসিতেন এবং আনন্দরাম হালদারের অতিথী হইতেন। মহারাজ পরম আনুষ্ঠানিক ছিলেন। স্বপাক ভিন্ন পরপাক আহার করিতেন না। পাকের জন্য মহিষীকে সঙ্গে লইয়া আসিতেন। হারিষ্যান্নই সাত্বিক মহারাজের আহার ছিল। রাজমহিষীর রন্ধনের সৌকর্য্যার্থ আনন্দরাম পূর্ব্ব হইতেই অতিশুষ্ক উত্তম কাষ্ঠ ও পবিত্র ভোজ্যাদি সংগ্রহ করিয়া রাখিতেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ভাটপাড়ার পণ্ডিতবর্গের সহিত বর্ষে বর্ষে সদালাপের সুবিধা স্থায়ী করিবার অভিপ্রায়ে ভাটপাড়া গ্রামের উত্তর অংশে গঙ্গাতীরে কতকটা বিস্তীর্ণ ভূমি নির্দ্দিষ্ট করিয়া রাখেন। পরে তাঁহার বংশীয় রাজা ৺শ্রীশচন্দ্রের সময় হইতে তথায় রাজবংশেরই বিগ্রহ শ্রী শ্রী ৺মদনমোহন জীউর রাসলীলা উতসব আরম্ভ হয়। ঐ রাস খুব ধূমধামের সহিতই বর্ষে বর্ষে সম্পন্ন হইত, কিন্তু এক্ষণে কালচক্রের পরিবর্ত্তনে সেই রাসোৎসবক্ষেত্রে য়ূরোপীয় বণিক্‌ প্রতিষ্ঠিত “নদীয়া জুটমিল” নামে এক চটকল স্থাপিত হইয়াছে। স্থানটি জেলা ২৪ পরগণার অন্তর্গত হইলেও ‘নদীয়া’ নাম কেবল পূর্ব্বস্মৃতি জাগাইয়া রাখিয়াছে। এই বংশের উপস্থিত বংশধরদিগের পিতা ৺রামধন হালদার মহাশয় একজন ঋষিকল্প ব্যক্তি ছিলেন। মস্তকে রজতশুভ্র কেশ, গলদেশে তুলসীমালা, গাত্রে নামাবলী দিয়া তিনি যখন দেবসেবা করিতেন তাঁহার রূপ তখন উথলিয়া পড়িত। বিষয়কর্ম্মত্যাগী এই ভক্তিমানের হৃদয়ে হরিভক্তি বড়ই প্রবল ছিল। বাড়ীতে নিয়মিতরূপে হরিসভা হইত, গ্রামের পণ্ডিতগণ তথায় সাদরে আহূত হইতেন। তাঁহারা একে একে এক-একদিন তথায় গীতা ব্যাখ্যা করিতেন আর হালদার মহাশয় একমনে তাহা শ্রবণ করিতেন। হালদার মহাশয় অতি তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছিলেন, প্রশ্নের দ্বারা ব্যাখ্যাতৃদিগকে অনেক সময়ে বিস্মিত করিতেন। হরিসভার অন্তে নগরসংকীর্ত্তন হইত। “পুত্রে যশসি তোয়েচ নরাণাং পুণ্যলক্ষণম্‌” এই যে মহাজন প্রবচন, ইঁহার যাথার্থ্য এই মহাত্মার পুত্রগণেই উপলব্ধ হইতেছে। মহাত্মা স্বর্গ হইতে তাঁহার পুণ্যদ্যোতক পুত্রগণকে আশীর্ব্বাদ করুন।